কোনো একসময় অমিতাভ ঘোষের "The Hungry tide" খুব আগ্রহের সাথে পড়েছিলাম। জেনেছিলাম সুন্দরবনবাসী দের জীবনে সুন্দর শব্দের অস্তিত্বই নেই। পরবর্তী কালে মহাশ্বেতা দেবীর ছোট গল্প "নুন" পড়েছিলাম ও সেখানে অনুভব করেছিলাম কোনো নির্দিষ্ট একটা আদিবাসী সমাজে এই "নুনের" গুরুত্ব টা কি? কিন্তু এই অনুভবগুলো আমার কাছে ছিল নিছক কাল্পনিক, সাহিত্য সংগৃহীত অনুভব। আর তাই অনেক কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি শুধুমাত্র পাঠ করে। বুঝতে পারিনি সুন্দরবন-বাসী ফকির কেন দিল্লি থেকে আশা ভাষাবিশারদ কানাইকে হঠাৎ বিপদের মাঝে ফেলে দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করেছিল। আশ্চর্য লেগে ছিল জেনে, যে শুধুমাত্র "নুন" চুরি করতে গিয়ে জংলি দাতাল হাতির হাতে প্রাণ যেতেপারে আদিবাসী পূর্তি, ও তার অন্য দুইজন আত্মীয়ের।
21.10.2021 বন্ধুদের সাথে জীবনের এক ঘেয়েমি কাটাতে অযোধ্যা পাহাড় গিয়েছিলাম, পুরুলিয়া। এই প্রকৃতিকে ওই পাহাড়ি পরিবেশে বেশ কিছুটা উচ্চতা থেকে উপভোগ করার সৌভাগ্য হলো আমার এতদিনে। গিয়ে দেখলাম সেই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনে দাগ কাটতে পারে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য : পাহাড়ি পথ, বন, বৃক্ষ, নদী, রাত্রি, সূর্যের উদয়োস্ত, নিস্তব্ধতা ও প্রশান্তি। সত্যিই ভালো লাগার মতোই।
আমরা চারজন, প্রণয়, সৌম্য, কৌশিক ও আমি মোটরবাইক চালিয়ে গিয়েছিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় পথ হারিয়েছিলাম আমরা। 15 কিমি রাস্তাটি যেতে প্রায় 45 কিমি রোমাঞ্চকর পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করেছিলাম আমরা। যাইহোক, অবশেষে দুই একজন স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলেই আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিলাম। বেশ কয়েকটি গ্রাম ও গ্রামের মানুষজন আমাদের এই খুঁজেপাওয়া গন্তব্যের পাহাড়ি পথের মধ্যে এসেছিল। লক্ষ্য করেছিলাম বেশ কয়েকটি মাটির বাড়ির দেওয়ালে লেখা... " আদিবাসীদের জমি দালালরা হুশিয়ার! আদিবাসীদের জমি ও জঙ্গল বেআইনি ভাবে অ-আদিবাসীদের লীজ, ভাড়া বা বিক্রয় করা যাবে না । " " কর্পোরেট রাজ হটাও।" ------
অনুভবকরেছিলাম আমাদের এই প্রমোদ, ফূর্তিতে এই গ্রামবাসীরা খুশি নয়। আমাদের এই অনধিকার প্রবেশে তারা ও তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ ও বিপন্ন। এটা তাদের কাছে বেআইনি, অনৈতিক, অনুচিত ও অভদ্রতা।
বিকেলবেলা আমাদের বেশ কয়েকটি আশপাশের পাহাড় ও পার্শ্ববতী এলাকা ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল। সেইমতো গেলাম। আমাদের মতই আরও কয়েকজন আমাদের আগে আগে পাহাড়ে উঠছিল। আমাদের আশেপাশে বেস কয়েকজন 6-7 বছরের বাচ্ছা ছেলেমেয়ে আমাদের অনুসরণ করতে থাকলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিছন থেকে আমার জামায় টানপড়লো। দেখলাম ওই বাচ্ছা গুলো আমাদের কাছে টাকা চাইছে। তৎক্ষণাৎ অনুভব করেছিলাম আমরা নিজেদের ভালো লাগানোর জন্য পাহাড়ে যাচ্ছি, কিন্তু সেখানকার সাধারণ মানুষ, যাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং মৃত্যু সব কিছুই ওই পাহাড় আর পাহাড়ি জঙ্গলকে ঘিরেই , তারা ভালো নেই।
কেউ আমাকে জানতে চাইলে, আমি বলবো, পুরুলিয়ার প্রাকিতিক সৌন্দর্য ও তার বিবরণ নতুন করে কিছু বলার নেই, ভালো লেগেছে। কিন্তু ওখানে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ, তাদের জীবন ধারণ , ও তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আমার একদমই ভালো লাগেনি। মন খারাপ হওয়ার মতই। আর আমি বিশ্বাস করিনা, ওই সাধারণ মানুষদের অবস্থা দেখে করো মন ভালো থাকতে পারে বলে।
রাত্রিবেলা আমরা "যুব আবাসে" ছিলাম। ওখানে সব কিছুর সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। দুইজন করে স্থানীয় আদিবাসী মানুষই ওই আবাসগুলোর দেখাশোনাতে নিযুক্ত দেখলাম। রাত্রিবেলা লক্ষ্য করেছিলাম ওনারা একটা বারান্দায় বসে মদ্যপান করছেন। পর্যটকরা যখন আবাসে মদ্যপান করেই থাকে তাহলে ওনাদের করতেও বাধা নেই। কিন্তু এই মদ, বিয়ার, বার ও রেস্টুরেন্ট এর সংস্কৃতি এই আদিবাসীদের একদা সংরক্ষিত জীবন শৈলীতে প্রবেশ করেফেলেছে। এর ফল কখনোই ভালো হওয়ার নয়। তাদের জমি, জঙ্গল, চাষবাস ও পশুপালনের সংস্কৃতি উপড়ে ফেলে শুধু মাত্র অরোপিত পর্যটক নির্ভর জীবনধারণে তারা যেন অসন্তুষ্টই মনে হল। উপলব্ধি করে ছিলাম।
যে পাহাড়ি ঝর্ণাধারার জল পানীয় গ্রামবাসীদের কাছে, সেখানে এই হোটেল ও রেস্টুরেন্ট দের নর্দমার দূষিত জল হানা দিয়েছে। তাদের এই পানীয় জল ক্রমশই দূষিত হচ্ছে, পানের অযোগ্য হচ্ছে। অনুভব করেছিলাম, আমরা যারা নৈসর্গিক প্রাকৃতিক ক্ষণিক সৌন্দর্য ভোগের নেশায় মত্ত হয়ে ওখানে গিয়ে প্রমোদ করছি, ওখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ক্ষণিকে দূষিত করছি সেই আমাদের ওই স্থানীয় পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনের সাথে কোনো যোগ নেই বটে, কিন্তু তাদের সাথে বেআইনি অনুন্নত কৃত্রিম আর্থিক একটা সম্পর্ক ও সংস্কৃতি সকলকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। বরং বলাযায়, আমাদের এই ফুর্তির বিভিন্ন মাধ্যমগুলী ওদের আপন সংস্কৃতির পরিপন্থী। ওদের ওই আদি ও স্ব-সংস্কৃতি আজ আমাদের কারণেই বিপদগ্রস্থ, ধ্বংসের মুখে। আদিবাসী শিশুদের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন সবকিছুই বিপথগামী।
আমরা ওই আদিবাসী বাচ্ছা ছেলেমেয়েদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে নিজেদের মহান ভাবতে শুরু করেছি, কিন্তু ওদের মধ্যেই আছে সেই ভবিষ্যৎ ফকির, যে একদিন সুযোগ পেলেই আমাদের মধ্যে থাকা কানাইয়ের কাছ থেকে সমস্ত হিসেব কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে।